১৯৪৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর। একটি প্রাণ চিৎকার করে জানান দেন, পৃথিবীকে আলোকিত করার। অভিনয়ের ‘অ’ শেখার আগেই নেমে যান অভিনয়ে। মাত্র ১০ বছর বয়সে করেন জীবনের প্রথম নাটক। ‘টিপু সুলতান’ নামের নাটকের মঁসিয়ে লালীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় স্কুলের এক অনুষ্ঠানে দ্বিতীয়বারের মতো নাট্যমঞ্চে ওঠেন। ‘কলির জিন’ নামে নাটকে অভিনয়ের জন্য প্রশংসিত হয়েছিলেন। তিনি আর কেউ নন, বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা আবুল হায়াত। অভিনয়ের সঙ্গে গলাগলি ভাবটা আসে বুয়েটে পড়ার সময়। চিটাগং কলেজ থেকে পাস করে ১৯৬২ সালে ভর্তি হন তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং টেকনোলজির (বর্তমান বুয়েট) সিভিল ডিপার্টমেন্টে। তখনই পরিচয় হয় নাটকপাগল কয়েকজনের সঙ্গে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে অভিনয়ের জন্য পরীক্ষা দেন। কিন্তু অকৃতকার্য হন! ১৯৬৮ সালে ঢাকা ওয়াসার প্রকৌশলী পদে যোগ দেন। পরের বছর ‘ইডিপাস’ নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে টিভিতে অভিষেক ঘটে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিটিভিতে প্রচারিত হয় তার অভিনীত নাটক ‘বাংলা আমার বাংলা’। এর আগে ১৯৭০-এ অনেক নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে আবুল হায়াত বিয়ে করেন তার মেজো বোনের ননদ মাহফুজা খাতুন শিরিনকে। বিয়ের এক বছরের মাথায় ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ যুদ্ধ শুরু হওয়ার মাত্র কদিন আগে ঘর আলো করে আসে তাদের প্রথম সন্তান বিপাশা। এর ঠিক ছয় বছর পর আসে নাতাশা। সেলিব্রেটি ফ্যামিলি বলতে যা বোঝায়, আবুল হায়াত পরিবার তার উজ্জ্বল উদাহরণ। পরিবারের কেউই অন্যের পরিচয়ে পরিচিত নন। প্রত্যেকে নিজেদের এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যে, আলাদাভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। শিল্পকলায় বিশেষ অবদানের জন্য একুশে পদক পেয়েছেন আবুল হায়াত।
বাবা চরিত্রে তিনি এমনই একজন অভিনেতা, যার মধ্যে অনেকে হারিয়ে যাওয়া বাবাকে খুঁজে বেড়ান। আবুল হায়াত একই রুটিনে চলাফেরা করার চেষ্টা করছেন। প্রতিদিন সকাল সাতটায় ঘুম থেকে ওঠেন। উঠে পান করেন দুই গ্লাস পানি, একটি বিস্কুট এবং দুধ-চিনি ছাড়া গ্রিন টি। এর পর কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে চোখ বুলান। ঠিক নয়টায় ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন। বাসায় ফিরে রাতে একই সময়ে ঘুমানোর চেষ্টা করেন। শহুরে জীবন থেকে গ্রমের জীবনযাত্রাই ভালো লাগে তার। মনে হয়, গ্রাম আসলেই সুন্দর, স্বস্তিদায়ক। গ্রামে গেলেই আবুল হায়াতের মনে পড়ে পুরনো দিনের কথা। বাবার কথা। তিনি বলেন, ‘মরহুম মোহাম্মদ আবদুস সালাম, আমার বাবা। তিনি ছিলেন পাকিস্তান ইস্টার্ন রেলওয়ের পার্সোনেল ব্রাঞ্চের অফিস সুপারিনটেনডেন্ট। সেই ১৯৪৪ থেকে মৃত্যুর আগ (১৯৬৯) পর্যন্ত চট্টগ্রামে বসবাস করেছেন। নানা শখের মধ্যে দুটি বিশেষ শখ তার ছিল- পাখি শিকার ও মাছ ধরা। এই দুই কারণেই প্রতি ছুটির দিন তার বরাদ্দ থাকত গ্রামে যাওয়া- পটিয়া, ধলঘাট, হাটহাজারী, নয়তো দোহাজারী কিংবা নাসিরহাট। ছোট্টবেলা থেকে বাবার সঙ্গী হতে ভালো লাগত আমার। পাখি ধরা কিংবা ছিপে মাছ উঠলে তা ছাড়ানো ইত্যাদি কাজে আমার উৎসাহ ছিল প্রচ-।’ বাবা দিবস নিয়ে আবুল হায়াত বলেন, ‘বাবারা বুক পেতে আগলে রাখবে সন্তান। শিক্ষা দেবে সন্তানকে জগতের যাবতীয় মঙ্গলকর বিষয়।
গড়ে তুলবে নিজ ছায়ায় উন্নততর মানুষ হিসেবে। তারই অনুপ্রেরণায় সন্তান একদিন ছাড়িয়ে যাবে বাবাকে। সেখানেই হবে তার আনন্দ। আব্রাহাম লিংকন তার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন- ‘বাবা, তুমি কী চাও, আমি বড় হলে কী হব?’ তার বাবা বলেছিলেন- ‘তোমার যা ইচ্ছা তা-ই হবে। তবে আমি চাই, তুমি যদি মাটি কাটার শ্রমিক হও, তোমার চেয়ে ভালো মাটি যেন কেউ কাটতে না পারে।’
রবীন্দ্রসংগীত আবুল হায়াতের খুবই প্রিয়। ভালোবাসেন বই পড়তে। উপন্যাস থেকে ইতিহাসনির্ভর বা ইনফরমেটিভ বই তার বেশি পছন্দ। উচ্চারণ নিয়ে তিনি বেশ সতর্ক থাকেন। আবুল হায়াতের ভাষ্যে, ‘দর্শকরা কখনই চায় না একজন অভিনেতা বা সংবাদপাঠক ভুল উচ্চারণ করুক।’ ক্রিকেট খেলার দারুণ ভক্ত তিনি। ক্রিকেট খেলা নিয়ে এই অভিনেতা বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেট খেলতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ও মাঠে গিয়ে খেলেছি। নিজেকে আমি মোটামুটি ক্রিকেটার বলতে পারি। শুধু ক্রিকেটার বললে অবশ্য ভুল হবে- অলরাউন্ড বলতে হবে। কারণ ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং- সবই করতাম। যদিও সবই খুব বাজে মানের ছিল, শেষ পর্যন্ত আম্পায়ারিং করে অবসর নিয়ে ফেলি। সেখানেও বাজে আম্পায়ারিংয়ের অভিযোগ ছিল আমার বিরুদ্ধে। তাতেও অবসর হয়নি। কারণ এখনো আমি ক্রিকেটের শ্রোতা ও দর্শক। রাত-দিন যখনই ক্রিকেট খেলা হয়, আমি আছি। হয় রেডিওতে, নয় টিভিতে। সেটা সম্ভব না হলে ইন্টারনেটে।’
একজন আবুল হায়াতের মাঝে সব আছে। আনন্দ, উত্তেজনা, উদ্দীপনা, উৎসাহ, মুগ্ধতা- সবই। এবারের জন্মদিন নিয়ে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বিশেষ কোনো আয়োজন করতে পারছেন না তিনি। কারণ দুটি- ১. বিপাশা হায়াত স্বামী তৌকীর আহমেদ ও সন্তানদের নিয়ে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন, ২. করোনা মহামারী। তবে আবুল হায়াত জানান, যেহেতু নাতাশার মেয়ে অর্থাৎ নাতনি শ্রীষার জন্মদিন একইদিনে- তাকে নিয়ে বিশেষভাবে কাটবে এবারের জন্মদিন। গুণী এই অভিনেতার ৭৭তম জন্মদিনে আমাদের সময়ের শুভেচ্ছা।
Leave a Reply